- 20 April, 2023
- 0 Comment(s)
- 877 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
সৈয়দা মোতাহেরা বানুর জন্ম ১৯০৬ সালে। বরিশালের বামনার জমিদার মীর সারওয়ার জান-এর বাড়ি। সারওয়ার জান মোতাহেরা বানুর মাতামহ ছিলেন। কবি মোতাহেরা বানুর জন্ম ও শৈশব-কৈশোর কাটে এই বাড়িতেই। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী কবি মোতাহেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। তবে সারওয়ার জান-এর বাড়িতে শিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল। নিয়মিত ইংরেজি, বাংলা, উর্দু কাগজ আসতো। মেয়েদের কথা ভেবে বাড়িতেই যাত্রা-থিয়েটারের আসর বসাতেন সারওয়ার জান। মোতাহেরার পিতা সাজ্জাদ মোজফ্ফরও মেয়ের শিক্ষার প্রতি যত্নবান ছিলেন। সংস্কৃত ও বাংলা কাব্যসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে পিতার হাত ধরে। ১৯১৯ সালে মাত্র সাড়ে তেরো বছর বয়সে মোতাহেরা বানুর বিয়ে হয়। প্রকৃতপক্ষে বিয়ের পরই মোতাহেরার কাব্যচর্চার শুরু।
মোতাহেরা লেখালেখি শুরু করেন শব্দ মেলানো শেখার মাধ্যমে। প্রথম শব্দ মেলানো শুরু করেন ধোপার হিসেবের খাতায়। তাঁর রচিত প্রথম কবিতা ‘খেলার সাথী’। এটি ১৩২৬ সনের চৈত্র মাসে প্রকাশিত হয় ‘সওগাত’ মাসিক পত্রে। ‘মোসলেম-ভারত’ সচিত্র মাসিক পত্রে মোতাহেরার আরও কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। 'বেগম' পত্রিকাতেও তাঁর রচিত কবিতা প্রকাশিত হয়। মোতাহেরাকে কাজী নজরুল ইসলাম ‘কবি বোন’ বলে সম্বোধন করতেন। বিখ্যাত সুর ও স্বরলিপি লেখক মোহিনী সেনগুপ্তর সঙ্গে কবি মোতাহেরার পরিচয় ঘটে। তাঁর ‘অধীরা’ কবিতাটিকে মোহিনী দেবী গানে এনে স্বরলিপি করার পর বিখ্যাত গায়ক কে.মল্লিক রেকর্ড করেন এই গানটি। এটিই বাঙালি মুসলিম মহিলা কবিদের মধ্যে প্রথম রেকর্ডকৃত গান। এই কবিতায় রাধাকৃষ্ণ কথা অবলম্বনে রচিত পদাবলী গানের চিরন্তন বাণী ও সুরের ধারা নিবেদিত হয়েছে-
তুমি কর গো আমায় বধির তোমার
অধীর বাঁশরী বাজায়ে,
এস হৃদি-কদম্বে শিহরণ তুলি
হিয়ার যমুনা নাচায়ে!
ধেনুগণ গোঠে নাহি আসে আর,
বাজে না তো বেণু এখানে,
বহে না উজান, বাঁশের বাঁশীর
বাজে নাকো তান সে-কানে।
মোতাহেরা বানুর ‘প্রতীক্ষায়’ কবিতাটিকেও গানে এনে স্বরলিপি করেন মোহিনী দেবী। এই দুটো কবিতার স্বরলিপিই মোহিনী দেবী রচিত ‘স্বর-মূর্চ্ছনা’ নামক গ্রন্থে স্থান পায়। মোতাহেরা বানুর কাব্যচর্চার জীবন দীর্ঘকালের নয়। বিয়ের দু-তিন বছর এবং জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কাব্যচর্চা করেছেন তিনি। তাঁর জীবনে প্রকৃতি ও বাস্তব যেভাবে প্রভাব ফেলেছিল তারই প্রকাশ কবিতাতে দেখা যায়। ১৯৭৩ সালে প্রয়াত হন কবি মোতাহেরা বানু।
কবি মোতাহেরা বানুর মেয়ে তাহমিনা বানু ১৯৭৪ সালে ইদ সংখ্যা ‘বেগম’ পত্রিকায় মাকে নিয়ে একটা লেখা প্রবন্ধে বলেন- ‘সৈয়দা মোতাহেরা বানু কাব্য জগতে হারিয়ে যাওয়া একটি নাম। সবার অলক্ষে নিঃশেষিত স্বেচ্ছা নির্বাসিত একটি কাব্য প্রতিভা। আপন ভুবনে আত্মসমাহিত নির্জনতাপ্রিয় আত্মপ্রচারবিমুখ এই কবিকে জানার সুযোগ অনেকেরই হয়নি। প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকালব্যাপী কবি মোতাহেরা বানু কাব্য-রচনা করে গেলেও রচনার স্বল্পতা ও ধারাবাহিকতার অভাবের জন্যই কাব্য জগতে তাঁর নাম আজ বিস্মৃতির অতলে বিলীন। কবি নিজেই বলে গেছেন-
এই যে আমার স্বেচ্ছা নির্বাসন,-
স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা দুঃখ অগণন;
এদের আমি কোথায় দেব স্থান?
কে কি দেবে এদের মূল্যমান।
আজ থেকে অর্ধ-শতাব্দীকাল আগে ভীরু দীপশিখা হাতে সাহিত্য অঙ্গনে কবির নিঃশব্দ পদচারণা মুসলিম মহিলাদের কাব্যচর্চার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।’ (সাঈদা জামান : সৈয়দা মোতাহেরা বানু, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ৪৩)
মোতাহেরা বানুর কবিতাগুলি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিল। অধ্যাপক অমলেন্দু দে এই কবিতাগুলি সঙ্কলন ও সম্পাদনা করে, 'কাফেলা : সৈয়দা মোতাহেরা বানু' শিরোনামে ২০০১ সালে ঢাকা প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশ করেন। গ্রন্থের ভূমিকাতে শ্রীদেবীপদ ভট্টাচার্য লিখেছেন-‘কবি হিসাবে তিনি সেইখানে মহৎ, যেখানে তিনি মর্ত্যমানুষের জীবনের জয়যাত্রার সঙ্গী,...কাব্যরসিকেরা এই কবিতা সংগ্রহকে বিনত শ্রদ্ধার সঙ্গে পড়বেন, বিশ্বস্ত অনুরাগের সঙ্গে গ্রহণ করবেন এসম্পর্কে আমার বিশ্বাস দৃঢ়মূল’।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৩ এপ্রিল ২০২১
ছবি : দুই কন্যাসহ মোতাহেরা বানু। সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment